সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : কলকাতা, ৩১, ডিসেম্বর, ২০২১। বিশ্বজুড়ে করোনা আতঙ্কের রেশ কাটার আগেই খ্রিস্টান ধর্মের ত্রাণকর্তা যিশুর জন্মদিনে মানুষ খুশির উৎসবে মেতে উঠেছেন। আতঙ্ক আর হতাশায় মাঝে এই উৎসব মানুষকে প্রাণশক্তি যোগাচ্ছে। আর কয়েকটি দিন। তারপর নতুন বছর। ২০২১। এবার আর ফেলে আসা বছরের জন্য মানুষের বিন্দুমাত্র মন খারাপ নেই। বরং মানুষ চাইছেন বিষে ভরা বিশ আপদ যেন দ্রুত বিদায় নেয়। যদিও নতুন বছর নিরাপদ হবে, কতটা আশাব্যঞ্জক হবে বিজ্ঞানীরা তা নিয়ে সন্দিহান। তবু মানুষ আশা নিয়েই নতুন বছর ২০২১এর আগমনের অপেক্ষায়। কিন্তু নতুন বছরের হিসেবটা কি ঠিক আছে? অর্থাৎ আগামী বছর কি সত্যিই ২০২১? শুনতে অবাক লাগলেও সত্যিই একটা কিন্তু আছে। ইতিহাস বলছে, আগামী বছর ২০২১ নয় কোনোমতেই। ২০২৩ ও হতে পারে। হতে পারে ২০২৪। তাহলে কেন ২০২১ কে বিশ্বে মানুষ নতুন বছরের হিসেব বলে মেনে নিয়েছে। এই হিসেব যিশুর জন্মের বছরকে ধরে মান্যতা পেয়ে আসছে। অর্থাৎ যিশুর জন্ম হয়েছিল আজ থেকে ২০২১ বছর আগে।
কিন্তু যিশুর জন্ম যে ২০২১ বছর আগে ২৫ ডিসেম্বর হয়েছিল তার কোনো উল্লেখ নেই বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টে। তাহলে কিসের ভিত্তিতে মানুষ এই হিসেব মেনে আসছে যুগ যুগ ধরে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হবে বহুবছর আগে। ইতিহাস আর গাণিতিক অঙ্ক অস্বীকার করতে পারেননি খ্রিষ্টান ধর্মের পীঠস্থান রোমের ভ্যাটিকানের পোপ ষোড়শ বেনডিক্ট। তিনি তাঁর লিখিত ‘জেসাস অফ নাজারেথ’ বইতে লিখেছেন, যিশুর জন্মদিন ও সালের হিসেবে ভুল গণনা করা হয়েছিল।

তাই খ্রিস্টের জন্ম সময়কে ধরে বছরের হিসেবে ভুল থেকেই গেছে।
তাহলে আসলে চলতি বছর কি ১০২০ নয়? আগামী বছরও কি তাহলে ২০২১ নয়? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চলুন যাই খ্রিস্টপূর্ব ৩২০০ বছর আগে। সেই সময়েই ক্রো ম্যাগনানগোষ্ঠী লুনার ক্যালেন্ডারের আবিষ্কারক। ক্যালেন্ডার মূলত অ্যাস্ট্রোনমি নির্ভর। ঋতু পরিবর্তনের ব্যাপারটি মনে রেখে বসন্তকালকে ধরে একটি ট্রপিক্যাল ইয়ার। অর্থাৎ ৩৬৫.২৪২১৮৯৬৬৯৮দিন। প্রতি ১০০বছরে যা আধ সেকেন্ড করে কমতে থাকে। চন্দ্রমাস কিন্তু চাঁদের পূর্ণচন্দ্র ও অর্ধচন্দ্রের অবস্থানকে নিয়ে তৈরি। একটি চন্দ্রমাস ২৯.৫২০৫৮৮৫৩১ দিনের, যা ট্রপিক্যাল ইয়ারে ১২.৩৬৮২৬৬৩৯২৭৫ টি চন্দ্রমাসের সৃষ্টি করে। এ এক জটিল অঙ্ক। অন্যদিকে, ইজিপশিয়ান ক্যালেন্ডার কিন্তু ব্যাবিলন, গ্রিক, রোমানদের সূর্যকেন্দ্রিক। কোন ধর্মীয় প্রভাব ছিল না। মূলত নীলনদের বন্যায় যে পলি পড়ত তাতেই ফলত সোনার ফসল। চাঁদের কোন প্রভাব ছিল না। ছিল ১২মাস ৩০দিন। একটি সপ্তাহ ধরা হতো ১০ দিনে। মোট ৩৬০ দিন। বাকি ৫দিন ধরা হতো ঈশ্বরের আবির্ভাব দিবস হিসাবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বা ধর্মগুরুদের তখনও লিপ ইয়ার সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। এই ব্যবস্থা ছিল রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজারের সময় পর্যন্ত।
ছয়হাজার বছর আগে জুলিয়াস সিজার , রাশিয়ান ধর্মযাজক ডেনিস এবং ত্রয়োদশ পোপ এই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে আধুনিক করলেন।
রাশিয়ান যাজক ডেনিস কনস্টানটিপোল যিশুর জন্মদিন ধরে ক্যালেন্ডার বানালেন। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের লক্ষ্য ছিল ট্রপিক্যাল ইয়ারের সঙ্গে সমন্বয় সূচিত করা। প্রতি চার বছরে ১দিন বাড়িয়ে সমস্যা মেটানো হলো। কিন্তু সমস্যা আর একটি ছিল। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে চার বছরে হচ্ছে ১৪৬১, দিন।

কিন্তু গড় তো ২৬৫.২৫ দিন। অর্থাৎ ট্রপিক্যাল ক্যালেন্ডার থেকে ১১ মিনিট ১৫ সেকেন্ড বেশি। ফলে ১২৮ দিনে একটা দিন বাড়ল। ১২৮ বছরে একটি দিন আগে বছর শুরু হলো। ঘটলো আর এক সমস্যা। চার্চগুলিতে বাধল গোল। ইস্টারের দিন ঘোষণা নিয়ে শুরু হয় তর্কবিতর্ক। পেশায় আইনজ্ঞ ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরি আত্মপ্রকাশ করেন ১৫৭২ খ্রিষ্টাব্দে।১৫৭৭:খ্রিস্টাব্দে ঘোষণা করলেন ক্যালেন্ডার সংশোধনের কথা।
ঠিক হলো ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দের ৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবারের পর শুক্রবার হবে ১৫ অক্টোবর। আরও অঙ্ক কষে ৩৬৫.১৪২৫দিনের হিসেবে তৈরি হলো। সবচেয়ে মজার কথা, পরবর্তীকালে পণ্ডিতেরা গণনা করে দেখলেন সম্রাট জুলিয়াস সিজারের যিশুর জন্মের বছরের হিসেবে গন্ডগোল করে ফেলেছেন। কিন্তু সম্রাট তো নিজের ভুল স্বীকার করতে পারেননা। তিনি তাঁর গণনায় স্থির রইলেন। এদিকে ডেল আরভিন ও স্কট সানকিস্ট গবেষণা করে তাঁদের ‘হিস্ট্রি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ক্রিশ্চিয়ান মুভমেন্ট’ গ্রন্থে লিখেছেন , ৩০০খ্রিস্টাব্দের আগে যিশুর জন্মদিন নিয়ে কোন ঐক্যমত ছিল না। সুতরাং ১ জানুয়ারি নিয়ে নতুন বছরের বিতর্কও থেকেই গেছে। যিশুর জীবনীলেখক রেঁনা লিখেছেন, অগাস্টাস সিজারের রাজত্বকাল ৭৫০ রোমান অন্দে বর্তমান খ্রীষ্টসনের কয়েক বছর পূর্বে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ঐতিহাসিক সাইমন সেবাগ মন্টেফিউরির মতে, যিশু জন্মেছিলেন খ্রীষ্ট পূর্ব ৪সাল আগে বা তারও আগে।

ঐতিহাসিক আইজ্যাক আসিমভেরও একই বক্তব্য। আবার ড: এস পিক জে স্টুয়ার্ড তাঁর ‘হোয়েন ডিড আয়োয়ার লর্ড অ্যাকচুয়্যালি লাইভ’ গ্রন্থে লিখেছেন যিশুর জন্ম হয় খ্রীষ্ট পূর্ব আট বছর আগে। ভারতের ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত জহরলাল নেহেরুও বলেছেন, খ্রিস্টের জন্মের কল্পিত তারিখ থেকে এই যুগের শুরু। প্রকৃতপক্ষে এই তারিখের চার বছর আগে খ্রিস্টের জন্ম হয়েছিল। ভারতীয় জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির অন্য ভারতীয় জ্যোতিষীদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, যিশু খ্রিস্টপূর্ব বারো অব্দের ২৬অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। এই সব তথ্যের যদি মান্যতা দিতে হয়, তাহলে চলতি বছর যেমন ২০২০ নয়, তেমন আগামী বছর ২০২১ নয়। হতে পারে ২০২৩, বা ২০২৪ বা ২০২৮ !!!!

Be First to Comment