জন্মদিনে স্মরণঃ আ লা উ দ্দি ন আ ল আ জা দ
“স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার?
ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো
চারকোটি পরিবার খাড়া রয়েছি তো!
যে-ভিত কখনো কোনো রাজন্য পারেনি ভাঙতে…”
[ আলাউদ্দিন আল আজাদ ]
বাবলু ভট্টাচার্য : প্রথম শহীদ মিনার ভাঙার প্রতিবাদে প্রথম কবিতা লিখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক প্রখর মেধাবী ছাত্র। নাম তার আলাউদ্দিন আল আজাদ। সেই ছেলের হাতেই পরবর্তীতে কী জন্ম নেয়নি? গল্প কবিতা, উপন্যাস, নাটক থেকে শুরু করে প্রবন্ধ, শিশু সাহিত্য, সাহিত্য গবেষণা, সাহিত্য সমালোচনা থেকে অজস্র বিষয়বস্তু। যিনি হয়ে উঠলেন এই বাংলার প্রথম সব্যসাচী সাহিত্যিক।
মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তার প্রবন্ধ ‘আবেগ’ ও গল্প ‘জানোয়ার’। অর্থাৎ কবিতা নয়, মননশীল রচনা ও কাহিনিমূলক গদ্যবয়ান দিয়েই তার যাত্রা শুরু।
তারপর গদ্যে-পদ্যে-সংলাপে তিনি অজস্র ধারায় বিচিত্র আঙ্গিকে লিখেছেন ও প্রকাশিত হয়েছেন। ২৪টি উপন্যাস, ১১৮টি গল্প, ১২টি নাটক, ১১টি কাব্যগ্রন্থ, ৫টি প্রবন্ধগ্রন্থ ও বেশ-কিছু সম্পাদিত গ্রন্থের জন্যে তিনি আমাদের অতিপ্রজ লেখকদের গোত্রভুক্ত।
তার সৃষ্টির পালা দিগন্ত জোড়া। ইউনেস্কো পুরস্কার পেয়েছেন তার ‘কর্ণফুলি’ উপন্যাসের জন্য। এক ডাকে বেস্ট সেলারের ঘরে নাম কিনেছে তার ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’। তার ‘স্মৃতির মিনার’ হয়ে উঠলো শহীদ মিনারের অন্যতম স্মারক কবিতা।
হলেন তিনি বহুমাত্রিক ও সব্যসাচী লেখক-কথাসাহিত্যিক, কবি, সনেটকার, নাট্যকার, চলচ্চিত্রের গল্পকার ও স্ক্রিপ্ট লেখক, টেলিফোনের জনপ্রিয় ধারাবাহিক আলেখ্যানুষ্ঠান রত্নদীপ-এর স্রষ্টা, শিশুসাহিত্যিক, আদর্শ পত্রলেখক, মুক্তিযুদ্ধের কথাকার এবং গীতিকারও।
ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক (১৯৪৯), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ স্নাতক (১৯৫৩) ও স্নাতকোত্তর (১৯৫৪) এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবন ও কবিতা’ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি (১৯৭০) লাভ করেন। পরে তিনি অরগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক সাহিত্যে উচ্চ প্রশিক্ষণ (১৯৮৩) গ্রহণ করেন।
তিনি নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজ (১৯৫৫), ঢাকা জগন্নাথ কলেজ (১৯৫৬-৬১), সিলেট এমসি কলেজ (১৯৬২-৬৮) এবং চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে (১৯৬৪-৬৭) অধ্যাপনা করেন। তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন (১৯৭৪-৭৫)। এ ছাড়া তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল প্রফেসর ও নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্বও (১৯৯০-৯২) পালন করেন।
ষাটের দশকে রচিত তার উপন্যাস ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’ ও ‘কর্ণফুলী’ ব্যাপক সাড়া জাগায়। তেইশ নম্বর তৈলচিত্র উপন্যাসটির বিষয়বস্তু অবলম্বনে ‘বসুন্ধরা’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সুভাষ দত্ত। এ চলচ্চিত্রটি দেশে-বিদেশে ব্যাপক প্রশংসিত হয়।
তার অন্যান্য উপন্যাসঃ ‘শীতের শেষরাত বসন্তের প্রথমদিন’, ‘ক্ষুধা ও আশা’, ‘শ্যামল ছায়ার সংবাদ’ উল্লেখযোগ্য।
নাটকের মধ্যেঃ ‘মরক্কোর যাদুকর’, ‘মায়াবী প্রহর’, ‘ধন্যবাদ’, ‘নিঃশব্দ যাত্রা’, ‘নরকে লাল গোলাপ’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
কাবগ্রন্থগুলির মধ্যেঃ ‘মানচিত্র’, ‘ভোরের নদীর মোহনায় জাগরণ’, ‘লেলিহান পান্ডুলিপি’, ‘নিখোঁজ সনেটগুচ্ছ’ ‘সাজঘর’ ও ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
আলাউদ্দিন আল আজাদ ভাষা আন্দোলনের গণমুখী ও স্বদেশপ্রেমী সাহিত্যধারার লেখক ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ তাকে প্রেরণাদীপ্ত দায়িত্ববান শিল্পীর ভূমিকা গ্রহণে উজ্জীবিত করে। মানুষ ও সমাজ আলাউদ্দিন আল আজাদের সাহিত্য ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু।
সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য আলাউদ্দিন আল আজাদ বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৪), ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৪), জাতীয় চলচিত্র পুরস্কার (১৯৭১), একুশে পদক (১৯৮৬), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক (১৯৯৪) লাভ করেন।
২০০৯ সালের ৩ জুলাই তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।
আলাউদ্দিন আল আজাদ ১৯৩২ সালের আজকের দিনে (৬ মে) নরসিংদী জেলার রায়পুর থানার রামনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment