———-শুভ জন্মদিন আরতি মুখোপাধ্যায়———
বাবলু ভট্টাচার্য : বাংলায় যে ক’জন কতিপয় “ভার্সেটাইল” সংগীতশিল্পী পেয়েছে তাদের মধ্যে আরতি মুখোপাধ্যায় প্রথম সারিতে সব সময় থাকবেন। বিভিন্নরকম গানে অনায়াস, সাবলীল বিচরণ। ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, হাল্কা- সবরকম গানেই তিনি স্বচ্ছন্দ। আরতি মুখার্জী অল্প বয়স থেকেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে, তিনি “মেট্রো-মরফি কনটেস্ট” সংগীত প্রতিযোগিতা অংশগ্রহণ করে তিনি বিজয়ী হন। তারপর থেকে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি ১৯৫৮ সালে মিনা কুমারীর অভিনীত হিন্দি ছবি ‘সাহারা’তে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসাবে প্রথম সুযোগ পান, কিন্তু সেই ছবির সংগীত ততটা সফল হয়নি। পরে ‘গার্ল ফ্রেন্ড’ (ওয়াহিদা রেহমান অভিনীত) এর মতো ফ্লপ ছবির পরে তিনি বাংলা ছবিতে গান করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সুযোগ আসে ১৯৬২ সালে ‘কন্যা’ নামে একটি বাংলা ছবির হাত ধরে।
তার অসামান্য গায়কী এবং অতি মধুর কণ্ঠ সবাইকে এতটাই মোহিত করেছিল যে তারা পূর্বের শীর্ষস্থানীয় গায়িকা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রতি মনোযোগ হারাতে শুরু করেছিলেন। ষাটের দশকের শেষের দিকে, তার কণ্ঠ সন্ধ্যা মুখার্জির পরিবর্তে শীর্ষস্থানীয় অভিনেত্রী সুচিত্রা সেনের নেপথ্য কণ্ঠ হিসাবে প্রথম ব্যবহৃত হয়। ১৯৬৬ সালে, তিনি ‘গল্প হলও সত্যি’ ছবিতে গান গেয়েছেন, যা সেরা মহিলা নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী জন্য ‘বিএফজেএ’ পুরস্কার পেয়েছিল। ১৯৭৬ সালে, তিনি ‘ছুটির ফাঁদে’ চলচ্চিত্রের জন্য পুনরায় পুরস্কারটি পান। তিনি ষাটের দশকের শেষভাগে মাধবী মুখার্জি, শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন, দেবশ্রী রায়, তনুজা প্রমুখ অভিনেত্রীদের নেপথ্য কণ্ঠে কাজ করেন এবং অনেকের মতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের শিল্পী জীবনের পতনের পিছনে একটি বড় কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়। ১৯৭৬ সালে, রাখি অভিনীত ছবি ‘তপস্যা’ ছবিতে দুটি গান গেয়েছিলেন। প্রথম গান ‘বাচ্চে হো তুম খেল খিলনে’ এবং কিশোর কুমারের সাথে ‘দো পাঁচি দো তিনকে’ খুব জনপ্রিয় হয়। তিনি বাংলা ভাষায় আনুমানিক ১৫০০০ গান গেয়েছেন এবং হিন্দিসহ অন্যান্য ভাষার গানেও নিজের কৃতিত্বের ছাপ রেখে চলেছেন।
ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’য় গান গেয়ে বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ড পান। ঋত্বিক ঘটক নাকি প্রস্তাব দিয়েছিলেন ‘সুবর্ণরেখা’য় অভিনয় করতে, ভয়ে রাজিই হন নি আরতি। ওই ছবির গান শুনে শ্যামল মিত্র ‘দেয়া-নেয়া’য় তনুজার লিপে গাওয়ান আরতিকে দিয়ে। ‘বিলম্বিত লয়’ ছবির প্রোডিউসার চেয়েছিলেন ‘এক বৈশাখে দেখা হল’ গানটি লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাওয়াতে। কিন্তু নচিকেতা ঘোষ এক- প্রকার জোর করেই আরতিকে দিয়ে গাওয়ান। এই গানগুলো তো এখন বঙ্গগানের অঙ্গ। সুধীন দাশগুপ্ত চিনেছিলেন এই কাঁচকাটা হীরেকে। তাই তো “Brazilian Group Singing” থেকে ‘বন্য বন্য এ অরণ্য’ গাওয়ালেন আরতি মুখোপাধ্যায়কে দিয়েই। ‘এই মোম জোছনায়’, ‘না বলে এসেছি’, ‘ওগো মনের দুয়ারে’, ‘যদি আকাশ হত আঁখি’, ‘টাপুর টুপুর সারা দুপুর’, ‘পথ ছাড়ো ছাড়ো’, ‘এই চারুকেশে সুচারু কবরী’, ‘তোমার চরণের ধ্বনি’, ‘তখন তোমার একুশ বছর’ ইত্যাদি কত যে গান! সুরকার কারা? সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষ, রবীন্দ্র জৈন, বাপ্পি লাহিড়ি প্রমুখ। রাজশ্রীর তারাচাঁদ বরজাতিয়া ‘সুবর্ণরেখা’ চলচ্চিত্রের গান শুনে মুম্বই যাবার প্রস্তাব দেন আরতিকে। তিনি ‘সওদাগর’ ছবিতে আরতিকে দিয়ে গাওয়ান। মুম্বইতেও নিজের যোগ্যতায় লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলের পাশাপাশি স্বতন্ত্র জায়গা করে নিতে সক্ষম হন আরতি মুখোপাধ্যায়।
‘গীত গাতা চল’ সিনেমা তাকে হিন্দিগানের জগতে পরিচিত করে তোলে। ‘গীত গাতা চল’ আর ‘হংসরাজ’ ছবির গানের রেকর্ডিং একইসাথে হয়েছিল, এতটাই ব্যস্ত তখন তিনি। লক্ষীকান্ত-প্যারেলাল, কল্যাণজি-আনন্দজি, রোশনজি, আর ডি গান গাওয়াচ্ছেন তাকে দিয়ে। ‘মাসুম’ ছবির ‘দো নয়না অউর এক কাহানী’ মুখে মুখে ফিরছে মানুষের। গুজরাটি, ওড়িয়া, অসমিয়া সহ বিভিন্ন ভাষায় প্লে-ব্যাক করেছেন। প্রথম স্বামী সুবীর হাজরা। বিবাহিত জীবন সুখের ছিল না। কলকাতা ছাড়ার এটাও কারণ ছিল। প্রবল ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এই গায়িকা নিজের গানের জন্য তদ্বির করেন নি। গেয়েছেন রবীন্দ্রসংগীতও৷ কিন্তু রবীন্দ্রসংগীতের মতো করেই। ক্লাসিকালের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে নিজের কালোয়াতি দেখান নি। গানে গানে ভরিয়ে দিলেন বাঙালিকে। আমরা পেলাম। গেয়ে যান আপন মনে– ‘হারিয়ে যেতে যেতে অজানা সংকেতে ছাড়িয়ে গেছি সেই পথ, কখনও মেঘে ঢাকা কখনও আলো মাখা ভুলেছি ভবিষ্যৎ…’
আরতি মুখোপাধ্যায় ১৯৪৩ সালের আজকের দিনে (১৮ জুলাই) পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment