ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ৭ জানুয়ারি ২০২২। ” লোচন দাস ( Lochan Das) !” (জন্ম -৯৩৯বঙ্গাব্দ/ ১৫৩২ খ্রিস্টাব্দ ও মৃত্যু ১০১৫ বঙ্গাব্দ/ ১৬০৮খ্রিস্টাব্দ ) ৷
কবি লোচন দাস “চৈতন্য মঙ্গল” কাব্যে”লোচন” , “লোচনদাস” , “ত্রিলোচন” , “সুলোচন” ও “লোচনানন্দ ” ভনিতায় লিখেছেন ৷ তাই , মনে হয় তাঁর আসল নাম ত্রিলোচন দাস / লোচনানন্দ দাস / সুলোচন ৷ আবার ধামালী পদের জন্য বৈষ্ণবরা তাঁকে “বড়াই বুড়ীর” অবতার ও “ব্রজের
বড়াই ” বলতেন ৷
সেদিন প্রণাম জানিয়ে এলাম কবির জন্মস্থানে গিয়ে ৷ পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট থানার নতুন হাটের পার্শ্ববর্তী কুনুর নদী তীরবর্তী উজানিনগর বা কুগ্রাম কিংবা আজকের কোগ্রাম থেকে ৷ ছবিটি তাঁর সমাধি
মন্দিরের ৷ যেখানে আজও তিনি পূজিত হন ৷ এটা তাঁর মামার বাড়ী এবং জন্মস্থান ৷ কোগ্রামের মঙ্গলচন্ডী মাতার সতীপীঠ( এখানে মায়ের বাঁ হাতের কনুই পড়েছিল) সংলগ্ন তাঁর জন্মস্থান , সাধনস্থল ও একসময়ের পাটবাড়ী ৷ পাশেই কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিকের জন্মস্থান ৷ কোগ্রামে লোচন দাসের সমাধিমন্দিরটি পিরামিড আকৃতির ৷ গৌর ও নিতাইয়ের মাঝে লোচন দাসের মাটির মূর্তি প্রতিষ্ঠিত আছে সমাধিগৃহের প্রবেশ দ্বারের দুদিকে দুটি চতুর্ভুজ বিষ্ণুমূর্তি ছিল ৷ ভেঙে যাওয়ার এখন সমাধিগৃহের কোনে রাখা আছে এই ঘরটি ১৫ফুট লম্বা , ১২ ফুট এবং ১১ ফুট উচ্চতার ৷চারপাশে আম সহ নানা গাছপালা ৷ তাঁর পৈতৃক নিবাস কাটোয়ার নিকটবর্তী শ্রীখন্ড গ্রামে ৷তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত বৈদ্য বংশের সন্তান ৷ বাবার নাম কমলাকর দাস ৷ মায়ের নাম অরুন্ধতী বা সদানন্দী ৷তিনি পিতৃ ও মাতৃ বংশের একমাত্র সন্তান ৷তিনি লিখেছেন ,” চারিখন্ড কথা সায় করিল প্রকাশ ৷
বৈদ্যকুলে জন্ম মোর কু-গ্রাম নিবাস ৷
মাতা মোর শ্রীশ্রীমতী সদানন্দী নাম ৷
যাঁহার উদরে জন্মি করি কৃষ্ণ কাম ৷
কমলাকরদাস নাম পিতা জন্মদাতা ৷
যাঁহার প্রসাদে কহি গৌর -গুণগাথা “৷
( চৈতন্য-মঙ্গল , শেষ খন্ড) ৷
তাঁর লেখা ” দুলর্ভসার ” পুঁথি থেকে জানতে পারি তাঁর পড়াশুনা প্রাথমিক ভাবে দাদামশাই ( মাতামহ) পুরুষোত্তম গুপ্ত ও দিদিমা ( মাতামহী)
অভয়া দাসীর কাছে ৷ তাঁরা ছিলেন পরম বৈষ্ণব ৷ নয় মাইল হেঁটে কোগ্রাম থেকে শ্রীখন্ডে গুরু নরহরি সরকার ঠাকুরের কাছে যেতেন ৷এমনিতে দস্যি হলেও ছোট থেকে লোচনের ছিল গুরু বৈষ্ণব সাধুতে ভক্তি ৷সে সময়ের রীতি অনুযায়ী খুব অল্প বয়সে ( মাত্র দশ বছর বয়সে ) গুরু নরহরি
চক্রবর্তীর ইচ্ছায় খুব ধূমধাম করে আমোদপুর কাঁকোটিয়া গ্রামের ধীরাজ দাসের মেয়ে সাত বছরের কাঞ্চনা দাসের বিয়ে হলেও
শিশু স্ত্রী থেকে যান বাপের বাড়ীতে ৷ কাঞ্চনা যৌবনপ্রাপ্তা হলে লোচন দীর্ঘকাল পরে শ্বশুরবাড়ী গেলেও বৌকে চিনতে পারেন নি ৷ বরং
এক মাঘ মাসে বৌকে আনতে কাঁকুটিয়ায় গেলেও পুকুরে হাত পা ধুতে গিয়ে এক যুবতীকে দেখে মা বলে সম্বোধন করেন ৷তাকে ধীরাজ দাসের বাড়ী কোথায় জানতে চাইলে সে দেখিয়ে দেয় ৷ শ্বশুরবাড়ী গিয়েতো চক্ষু চড়ক গাছ ! ঐ যুবতীইতো তার বিবাহিতা স্ত্রী ৷ যাকে অজান্তে মা ডেকেছেন তাকে আর স্ত্রী হিসাবে নিয়ে আসতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন ৷ এরফলে তাঁদের আর দাম্পত্য সর্ম্পক হয়নি ৷চিরকুমার ব্রহ্মচারী ছিলেন ৷ তবে , উভয়ের মধ্যে প্রেম
ও প্রীতির সম্বন্ধ আজীবন বিদ্যমান ছিল ৷ তিনি হয়েছিলেন লোচনের সাধন সঙ্গিনী ৷আর ঐ মহীয়সী মহিলার প্রভাবেই তিনি সমধুর চৈতন্য মঙ্গল লেখেন ৷ বলেছেন দাদুর প্রসাদে তিনি চৈতন্যমঙ্গল লিখতে পেরেছেন ৷আনুমানিক ১৫৬০ খ্রিস্টাব্দে তিনি গৌরাঙ্গের গুণকীর্তনের জন্য ঐ গ্রন্থ লেখেন ৷মাত্র ১৪ বছরে তাঁর কবি জীবনের শুরু ৷ এছাড়া তিনি “দুর্লভসার “, “চৈতন্য প্রেমবিলাস” , “বস্তুতত্ত্বসার” , “আনন্দ লতিকা ” বই লিখেছেন ৷ রায় রামানন্দের সংস্কৃতে লেখা “জগন্নাথবল্লভ” নাটকের বাংলা ভাবানুবাদ করেন ৷আরো কিছু পদাবলী গান তিনি লিখেছিলেন ৷তাঁর লেখা সমধুর ও আজও বৈষ্ণব সমাজে সমাদৃত ৷তিনি কঞ্চির (বাঁশের) কলমে তেড়েটের পাতায় লিখতেন ৷ নরহরি দাস তাঁকে জন্মস্থান কোগ্রামে গিয়ে চৈতন্যমঙ্গল রচনার আদেশ দিয়েছিলেন ৷
গান গাওয়ার মত করে ভনিতাযুক্ত ছন্দোবদ্ধ রচনাকে “পদ” বলে ৷ যাতে প্রেমের বিভিন্ন ভাগ , বাৎসল্য ও সখ্য রস রয়েছে ৷ বৈষ্ণব পদাবলী বা কবিতা বৈষ্ণবতত্ত্বের রসভাষ্য ৷
চৈতন্যদেবের জীবন ও লীলা নিয়ে রচিত প্রথম কাব্য মুরারি গুপ্তের” শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যচরিতামৃত বা কাব্য কড়চা” (১৫৩৬-১৫৪০) রচিত হয়েছিল সংস্কৃতে ৷ যেখানে গৌরাঙ্গের অবতারত্ব বা ঈশ্বরত্ব
দেখানো হয়েছিল ৷ অন্যদিকে বাংলায় এ ধরণের রচনায় অবতার শ্রীচৈতন্যর সাথে তাঁর মানবিক গুণাবলীও তুলে ধরা হয় ৷ প্রথম এমন বই বৃন্দাবন
দাসের” চৈতন্য ভাগবত” (১৫৪৬-১৫৫০) ৷আসলে বৃন্দাবন দাস লোচনের সুপাঠ্য চৈতন্যমঙ্গল পড়ে নিজের কিব্যের নাম চৈতন্যমঙ্গল পরিবর্তন করে রাখেন চৈতন্যভাগবত ৷তবে , চৈতন্যমঙ্গল নামে আমরা দুটি রচনার কথা জানি ৷
জয়ানন্দের “চৈতন্যমঙ্গল” (১৫৬০) ৷ যেখানে ভক্তির প্রাধান্য ৷ মহাপ্রভুর ঈশ্বরত্ব প্রকাশিত ৷ যা ছিল পালাগানের রীত অনুযায়ী নয় খন্ডে বিভক্ত ৷অন্যদিকে লোচনদাসের “চৈতন্যমঙ্গলে” মাতৃমমতা
মন্ডিত বাল্যলীলা , গৌরাঙ্গ ও বিষ্ণুপ্রিয়ার দাম্পত্যজীবন সহ গৌরাঙ্গের মানবিক কর্মাদি
পরিস্ফুট হয়েছে ৷ অলৌকিকতা মুক্ত মঙ্গলকাব্যের আঙ্গিকে লেখা এই পালার চার খন্ড -সূত্র , আদি , মধ্য ও অন্তখন্ড ৷ এর ছত্র সংখ্যা এগারো হাজার ৷কৃষ্ণদাস কবিরাজের “শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত”-র মত না হলেও
লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল যথেষ্ঠ জনপ্রিয় ৷ লোচন দাসের কাব্যে মুরারি গুপ্তের প্রভাব থাকলেও তিনি দেখিয়েছেন শ্রীচৈতন্য দিব্যোভাবে পুরীর জগন্নাথদেবের শরীরে বিলীন হয়েছিলেন ৷” লোচনদাস লিখেছেন ,” কৃপা কর জগন্নাথ পতিতপাবন ৷কলিযুগ আইল এই দেহত শরণ ৷৷ এ বোল বলিয়া সেই ত্রিজগত রায় ৷ বাহু ভিড়ি আলিঙ্গন তুলিল হিয়ায় ৷৷ তৃতীয় প্রহর রবিবার দিনে ৷ জগন্নাথে লীন প্রভু হইলা আপনে ৷৷”৷যাতে প্রমাণ হয় চৈতন্যদেব নারায়ণের অবতার ৷তাঁর লেখা পরিশীলিত ও বৈদদ্ধ্যপূর্ণ ৷ যেখানে নিজ পৈতৃক আবাস অন্যতম বৈষ্ণবপীঠ শ্রীপাট শ্রীখন্ডের ভাবধারা অনুসারে “গৌরনাগর” রূপে মহাপ্রভুর ভাবমূর্তি উন্মোচন করেছেন ৷ধর্মীয় সাহিত্য হলেও লোচন দাস সহ বৈষ্ণব সাহিত্য
বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ ৷এখন পেশায় চিকিৎসক হলেও আমার পুরানো পেশা সাংবাদিকতা ও নেশা বেড়ানো ৷ নবদ্বীপের পার্শ্ববর্তী বর্ধমান জেলার মানুষ বলে শ্রীচৈতন্যদেব স্মৃতি বিজরিত স্থান ও গৌড়ীয় বৈষ্ণব তীর্থক্ষেত্র বেশী প্রিয় ৷ তাই গিয়েছিলাম লোচন দাসকে শ্রদ্ধা জানাতে ৷ প্রণাম করলাম শ্রীশ্রীগৌর নিত্যানন্দকে ,-“বন্দে শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য নিত্যানন্দৌ সহোদিতৌ ৷ গৌড়োদয়ে পুষ্পবন্তৌ চিত্রৌ শন্দৌ তমোনুদৌ ৷৷ আজানুলম্বিত- ভুজৌ
কনকাবদাতৌ সঙ্কীর্ত্তনৈক -পিতরৌ কমলায়তাক্ষৌ ৷ বিশ্বম্ভরৌ দ্বিজবরৌ যুগধর্ম-পালৌ বন্দে জগৎ প্রিয়করৌ করুণাবতারৌ ৷” হরে কৃষ্ণ !
আমোদপুর কাঁকোটিয়া গ্রামের ধীরাজ দাসের মেয়ে সাত বছরের কাঞ্চনা দাসের বিয়ে হলেও শিশু স্ত্রী থেকে যান বাপের বাড়ীতে ৷ কাঞ্চনা যৌবনপ্রাপ্তা হলে লোচন দীর্ঘকাল পরে শ্বশুরবাড়ী গেলেও বৌকে চিনতে পারেন নি….. ৷
More from CultureMore posts in Culture »
- হৃষিকেশ পার্কের মিলন সমিতির দেবী সরস্বতীর বন্দনা….।
- মহাজাতি সদনে মহাসমারোহে নেতাজি স্মরণ….।
- হায়াত রিজেন্সি কলকাতায় উদযাপন করল ২০২৫ সালের চাইনিজ নববর্ষ সাংস্কৃতিক উদ্দীপনার সঙ্গে….।
- ওড়িয়া শিল্পী চন্দন নায়কের একক শিল্প প্রদর্শনী…।
- Ramayan Cultural Centre celebrates the First Anniversary of the Ram Mandir Inauguration in Ayodhya….Ramayan Cultural Centre celebrates the First Anniversary of the Ram Mandir Inauguration in Ayodhya….
- কালনাগিনী নদীবক্ষে গঙ্গারতি ও প্রণব সংস্কৃতি মেলা….।
More from GeneralMore posts in General »
- Neotia Bhagirathi Women & Child Care Centre brings back its iconic kids’ carnival – Baby’s Day Out, after a decade….
- TV9 বাংলার নতুন নিউজ সিরিজ ‘অমৃতকুম্ভে মৃত্যুমিছিল’….।
- Sunday Suspense Marks 15 Years with Expanding Storytelling Universe…
- Rapido to Invest ₹150 Crore in Mobility and Infrastructure in partnership with West Bengal Transport Department….
- Desun Hospital Observes World Cancer Day 2025 with Music Therapy and Awareness Initiatives…
- টালিগঞ্জে স্বামী প্রণবানন্দ বিদ্যাপীঠের সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষের সূচনা হলো..।
More from SocialMore posts in Social »
- কালনাগিনী নদীবক্ষে গঙ্গারতি ও প্রণব সংস্কৃতি মেলা….।
- Senco Gold & Diamonds commences New Year with an innovative CSR initiative to acknowledge the struggling artisans of Bengal to maintain the existence of diminishing Art Forms of West Bengal….
- Empowering Through Education: Himalaya Wellness Concludes second edition of ‘My First Pimple’ Campaign…..
- কেন্দ্রীয় অর্থ ছাড়া গঙ্গাসাগরের পৌরাণিক মাহাত্ম্য পূর্ণ মহর্ষি কপিল মুনির সাধনার স্থলের এই ঐতিহ্য রক্ষা করা যাবে না – স্বামী পরমাত্মানন্দ….।
- শিশুদের সাথে নতুন বছরের আনন্দে মেতে উঠলো শ্যাম সুন্দর কোং জুয়েলার্স….।
- Acropolis Mall Unveils Grand Christmas Carnival: A Spectacular Celebration of Fun and Festivities!…
Be First to Comment