জন্মদিনে স্মরণঃ আনা ফ্রাঙ্ক
বাবলু ভট্টাচার্য : ১৯৩৯ সালে জার্মানির পোল্যান্ড দেশ আক্রমণের মাধ্যমে পৃথিবী জুড়ে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। শবলোভী শকুনের ডানায় ঢাকা পড়ে সূর্য। ইহুদি-বিরোধী ফতোয়া জারি করে চলে দখলদার নাজিবাহিনী। যে দেশে আক্রমণ চালাতো সে দেশের ইহুদিদের উপর চালাতো অত্যাচার, নৃশংসতা।
ইহুদিরা ট্রেনে চড়তে পারবে না, ট্রামে চড়তে পারবে না, ‘ইহুদিদের দোকান’ বোর্ড টাঙানো গুটিকয়েক দোকান থেকে কেনাকাটা সারতে হবে। বেলা তিনটে থেকে পাঁচটার মধ্যে বাইসাইকেল চড়া নিষিদ্ধ, সিনেমা-থিয়েটারে কিংবা বারোয়ারি খেলাধুলোয় ইহুদিদের প্রবেশ নিষেধ।
এমনকি নিজেদের বাড়ির বাগানেও রাত আটটার পর বসা আইনত দণ্ডনীয়। পড়াশোনার জন্য নির্দিষ্ট কয়েকটি ‘ইহুদি বিদ্যালয়’ এবং প্রত্যেক ইহুদির জামায় একটি ছ’কোণা ‘হলুদ তারা’ লাগানো বাধ্যতামূলক ছিল। এই তারাটি ইহুদিদের পরিচয়ঘোষক। কে ইহুদি আর কে ইহুদি নয়, তার নির্লজ্জ নিশান।
ঠিক সেই সময়টাতেই হল্যাণ্ডে বসবাসরত দশ বছরে পা রাখলো আনা, ছোট্ট আনা ফ্রাঙ্ক।
ফ্রাঙ্ক পরিবার ছিল জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট-অন-মাইন শহরের বাসিন্দা, ধর্মের বিচারে ইহুদি। পরিবারের প্রধান যে মানুষটি, তাঁর নাম অটো ফ্রাঙ্ক। সহধর্মিণী এডিথ হল্যাণ্ড ও দুই মেয়ে শিশুকে নিয়ে ছিল সাজানো-গোছানো এক সংসার।
১৯৩৩ সাল। বড় মেয়ে মারগটের বয়স তখন সাত। আনার চার। স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে জার্মানি ছেড়ে হল্যান্ডে চলে গেলেন অটো ফ্রাঙ্ক। অজস্র পরিবারের সঙ্গে ছিন্নমূল হলো আরেকটি বনেদি পরিবার।
হল্যান্ড। আমস্টারডাম শহর। ট্রাভিস এন.ভি-র ম্যানেজিং ডিরেক্টর পদে যোগ দিলেন অটো ফ্রাঙ্ক। পাঁচ বছরের আনা ভর্তি হল মন্টেসরি কিন্ডারগার্টেনে।
১৯৪১ সালে তেরো বছরের আনা ভর্তি হন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ওদিকে জার্মানির মাঠ-ঘাট-রাজপথ প্রতিদিন স্নাত হচ্ছে ইহুদিদের রক্তে। হতভাগ্য অগণিত ইহুদি দিন কাটাচ্ছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মৃত্যুমাখা অন্ধকারে। এই নির্বাসিতের তালিকায় বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনও ছিলেন।
১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তিন বছরের দানব ততদিনে। জুলাই মাসের পাঁচ তারিখে নাজি ঝটিকাবাহিনী খোঁজ পাঠালো অটো ফ্রাঙ্কের নামে। কিন্তু আত্মসমর্পণ করে বন্দিশিবিরের বাসিন্দা হতে রাজি ছিলেন না অটো ফ্রাঙ্ক। কয়েকজন বন্ধুর সাহায্য নিয়ে নিজেদের অফিস-বাড়ির পেছন দিকে বানিয়ে নিলেন ‘গোপন আস্তানা’। সামনের দিকে সাজানো-গোছানো রইল মানুষের নজর এড়ানোর নানা কৌশল।
৬ জুলাই থেকে ঐ গোপন আস্তানার বাসিন্দা হল দুটি ইহুদি পরিবার, মোট আটজন মানুষ। ফ্রাঙ্ক পরিবারের চারজন, তাদের বন্ধু ফান ডান পরিবারের তিনজন আর ডুসেল।
এবং ঐ গোপন আস্তানায় আত্মগোপনের প্রহরেই পরিবারের সীমায়িত গণ্ডি ছাড়িয়ে অনেক বড় গণ্ডিতে ছড়িয়ে গেল এক সদ্য কিশোরী- আনা ফ্রাঙ্ক।
আত্মগোপনের দিনক্ষণের হিসেবে আনার বয়স তখন ঠিক তেরো বছর চব্বিশ দিন। চব্বিশ দিন আগে মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে বাবা অটো ফ্রাঙ্ক আনাকে উপহার দিয়েছিলেন একটি ডায়েরি। এবং এই সেই ডায়েরি, যা আশি বছর পেরিয়ে আজো বিশ্ব ইতিহাসের জীবন্ত কিংবদন্তিরূপে সৃষ্টিজগতের অমূল্য সম্পদ।
এই পঁচিশ মাসে ঐ ডায়েরির পৃষ্টায় জন্ম নিয়েছে চিরন্তনী এক আনা ফ্রাঙ্ক। অমেয় গভীরতা আর আশ্চর্য সারল্যে ডায়েরির ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে আনার মনন, তাঁর জীবনবোধ, মানুষ-প্রকৃতি-ঈশ্বর বিষয়ে তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, সেই সময়ের পৃথিবীর যুদ্ধ নামক ভয়ঙ্করতম ঘটনাটি সম্বন্ধে তাঁর সমস্ত ভাবনা।
গুপ্ত মহলে অবরুদ্ধ আনা এবং তাঁর পরিবার সদা আতঙ্কে থাকত। কারন কোন প্রকার ভদ্রতা ছাড়াই গেষ্টাপো বাহিনী ইহুদীদের ডজনে ডজনে তুলে নিয়ে যেত। এর মাঝেও আনা ‘লা বেলে নিফেরনাইসে’ থেকে একটা করে অধ্যায় পড়ে ফেলত। নতুন শব্দগুলো খাতায় টুকে রাখত।
লেখক হবার স্বপ্ন দেখত আনা। স্বপ্ন দেখত মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকার। বেঁচে থাকলে আজ বয়স হতো বিরানব্বই। সে বেঁচে নেই। কুড়িতেই ঝরে গেছে। বেঁচে আছে শুধু দিনলিপি, আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি।
৪ আগস্ট ১৯৪৪ সালের সকালে তাঁরা জার্মান নিরাপত্তা রক্ষীদের হাতে ধরা পড়েন এবং তাঁদেরকে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে ১৯৪৫ সালে টাইফাসে আক্রান্ত হয়ে তাঁরা দু’জনেই মৃত্যুবরণ করেন।
আনা ফ্রাঙ্ক ১৯২৯ সালের আজকের দিনে (১২ জুন) জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট-এ জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment