ডঃ পি সি সরকার,(জুনিয়র) বিশ্বখ্যাত জাদুশিল্পী ও বিশিষ্ট লেখক। কলকাতা, ২৯, নভেম্বর, ২০২০। বাবার ইন্দ্রজাল আমি অডিটোরিয়ামে, চেয়ারে বসে দেখার সুযোগ খুব কম পেয়েছি। সব সময় হাউস ফুল। একটা চেয়ারও খালি নেই। আর তাছাড়া, স্টেজে বাবার সহকারী হিসেবে মঞ্চে তার সঙ্গে , বা উইংসের ভেতর থেকে নজর রেখে বা দৃশ্য পরিবর্তনে সাহায্য করেই আমার দিন কেটেছে। একবার চান্স পেয়েছিলাম, শেষ টুকূ দেখতে। সেদিন আমার দিদিমা এবং দাদু এসেছিলেন তাদের জামাই-এর ম্যাজিক দেখতে। দাদু, প্রমথ নাথ মজুমদার হচ্ছেন স্বদেশী আন্দোলনের আদর্শে গড়া ডাক্তার। আমাদের স্বর্গগতঃ রাষ্ট্রপতি ডঃ জাকির হোসেনের সহপাঠি। গলায় গলায় ভাব ছিল। সেজন্য কোনও অনাচার দেখলেই হুঙ্কার দিতেন- “জাকির্ -রে কোইয়্যা দিমু।
তোমারে জেলে ঢুকামু”। সেই ডাক্তার-দাদু সস্ত্রীক নিউ এম্পায়ার হলে ঢুকতেই দেখেন এক ভদ্রলোক রাস্তায় ছট্ফট্ করছেন আ্যপেনডিক্সের যন্ত্রণায়। ব্যাস্, জামাই-এর ম্যাজিক শিকেয় উঠলো। দিদিমাকে আমাদের জিম্মায় রেখে, আমাদের গাড়িতে রুগীকে তুলে, কারুর আপত্তি না শুনে, অন্য কাউকে ভরসা না করে সোজা চলে যান পি জি হাসপাতাল। দিদিমাও যেতে চাই ছিলেন। কিন্তু দাদুর ধমকে মত পাল্টান। “তুমি মাইয়্যা লোক, এইডা পুরুষের কাজ, ডাক্তারের ধর্ম, তুমি যাও, লৌকিকতা রক্ষা করো। তুমি ম্যাজিক দ্যাখো, আমি এই এক্ষুনি ফিরয়্যা আইসতাসি। যামু আর আসুম।”
কার সাধ্য স্বদেশী বয়স্ক বাঙাল ডাক্তারকে খ্যাপায়?! জাকিরকে কইয়্যা দিবো না?
বাবাকে কিচ্ছু জানানো হয়নি। দিদিমা স্মার্টলি একা বসে আছেন। পাশে দাদুর সিট-টা খালি। দিদিমার ঠিক সামনে এক নব-বিবাহিত দম্পতি বসে। বৌটা আড়ষ্ট। কিন্তু বরটা বারবার বৌএর দিকে ঝুঁকে তিনি যে কতো চালাক, সব বুঝে ফেলেছেন সেটা বোঝাতে বারবার বৌ-এর দিকে ঝুঁকে দু-হাত নেড়ে বকর্-বকর্ করছে। আসেপাশের সবাই বিরক্ত। বর-এর কোনো বিকার নেই। দিদিমার শো দেখতে খুব অসুবিধে হচ্ছিল। মাথা এপাশ থেকে ওপাশ বারবার করছেন। দাদু ফেরেন নি। আমি শো এর ফাঁকে এসে দেখে যাচ্ছি।
শেষ আইটেম। ব্ল্যক আর্ট, অন্ধকারের ম্যজিক। আমি একটু ফাঁকা আছি। দিদিমার কাছে গিয়ে বসি। দিদিমা ফিশফিশ করে আমার কানে কানে বললেন সামনের ওই দম্পতির কথা। বলেন “বৌ-টা ভালো। কিন্তু বরটা অভদ্র। ভীষণ ডিস্টার্ব কইরতাছে। তোমার দাদু থাইকলে দ্যাখাইয়্যা দিত মজা। কিচ্ছূ দেইখতে পারি নাই। মাথাটা খা-লি এদিক ওদিক করে। স্থির হইয়্যা বসে না। নির্লজ্জ।বিয়্যা আমরাও করলি, এই রকম করি নাই।”
দাদু না থাকলেও তার এক্সারসাইজ করা বাঙাল
নাতি তো হাজির আছে। দিদিমাকে ইশারায় চুপ করতে বলি।
ওদিকে বাবা ঘোষণা করছেন, “ঘুরঘুট্টি অন্ধকার করো। মাথার ওপর দিয়ে ভুত আসবে…শুকনো
কঙ্কাল….ওই দেখুন”। বরং বাহাদূর তখনো সক্রিয়।
বরং তখনো জ্ঞান দিয়ে বৌকে বলছে,”সব সূতো দিয়ে ঝোলানো, পুতুল নাচের ব্যাপার…”
অনেক কঙ্কাল উড়ে, নেচে লাফিয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে ফিরে চলে যায়।
আমি ছিলাম এই সময়টার অপেক্ষায় । উঠে দাঁড়িয়ে মনে মনে ‘জয় তারা-মা’ বলে যতো শক্তি আছে তা সঞ্চয় করে ঐ বর বাবা-জীবনটির মাথায় কষে একটা গাট্টা মারি। জবাবে শুনি -“আ-উঃ । বাবারে”
আমি নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে বসে থাকি।
লাইট জ্বলে।
বৌটা এই প্রথম মুখ খোলে–“কী হয়েছে?”
মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বলে, “…একটা ভুতের সৃতো ছিঁড়ে …আমার মাথায়…খটাস্….।”
আরও ঘণ্টা খানেক পর দাদু ফিরে এসে বলেন,”অপারেশন সাকসেসফুল”
আমি দিদিমার সঙ্গে সমস্বরে বলি- “আমাদেরটাও শেষ পর্যন্ত সাকশেষfool.”
বিস্তারিতভাবে কিছু বলিনি, ভয়ে।
যদি জাকিরকে কইয়্যা দ্যান!

Be First to Comment