Press "Enter" to skip to content

আজ সারা বিশ্ব জুড়ে পালিত হচ্ছে “আর্ন্তজাতিক নার্সেস দিবস”…..।

Spread the love

ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ১২ মে ২০২২।
নার্সিং( Nursing ) এমন একটা পেশা যা জনসাধারনের স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও স্বাস্থ্য সচেতনতা মূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে ব্যক্তিগত , পারিবারিক ও সামাজিকভাবে কোন রোগী বা ব্যক্তির স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করেন ৷”নার্স” একটি ল্যাটিন শব্দ ” Nutrire” থেকে এসেছে ৷ এর মানে “স্তন্যপান করানো ” ৷ হয়তো স্তন্যদান করতে অক্ষম মায়ের বিকল্প হিসাবে প্রচলিত দুধ মা বা স্তন্যদায়িনী মা কথা থেকে এর উদ্ভব ৷ তবে, এর ব্যবহার সেবা মূলক কাজে ৷ ইতিহাসে প্রথম নার্সের বিবরণ পাই প্রথম শতাব্দীতে যিশুর শিষ্য সেন্ট পলের “ফেবি” নামের এক মহিলাকে সেবার জন্য পাঠানোর ঘটনা থেকে ৷ যা বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের ষষ্ঠ গ্রন্থে পড়েছি ৷ তখন খ্রিস্টীয় সন্ন্যাসিনী বা নান রা “সিস্টার” নামে নার্সের কাজ করতেন ৷ ঐতিহাসিক জিওফ্রে ব্লেনির লেখা থেকে প্রথম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের গুটি বসন্ত ও দ্বিতীয় শতাব্দীর মাঝের দিকে হামের মহামারিতে আদি খ্রিস্টানদের উদ্যোগে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সেবামূলক নার্সিং শুরু হয় ৷ এবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের বিষয় বা থিম করেছে নার্সদের সম্মান৷ একজন চিকিৎসক হিসাবে জানি একবার বিষয় ছিল ” সার্পোট নার্সেস এন্ড মিড ওয়াইভস ” ৷ একসময়ের নারীদের পেশা হলেও এখন নার্সিংএ অনেক পুরুষও এসেছেন ৷ আমার কাছে নার্সিং পেশা খুব সম্মানের ৷ আর্নেস্ট হেমিংওয়ের “আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস ” ৷ ঐ গ্রন্থের একটি উজ্জ্বল চরিত্র “ক্যাথরিন বার্কলে “নামের এক নার্সের ৷ মনে করা হয় যোদ্ধা লেখক হেমিংওয়ে ইটালির মিলানের রেড ক্রশ হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় ১৯ বছর বয়সী “এগনেস ভন কুরোস্কি” নামের ১৯ বছর বয়সী এক পূর্ব ইউরোপীয় বংশদ্ভূত আমিরিকান নার্সের প্রেমে পড়েন ৷ সেই প্রেম সফলতা না পেলেও ঐ চরিত্রের প্রেরণায় আমরা পাই হেমিংওয়ের ঐ অমর সৃষ্টি ৷ এমনই আরেক সৃষ্টি “দি স্নো অফ কিলিমাঞ্জারো ” ৷ আজও আমার মনে দাগ কেটে আছে ৷১২ মে এই আধুনিক নার্সিং এর অগ্রদূত
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের ( Florence Nightingale)
এর জন্মদিন ৷ তিনি নার্সিং নীতিমালা “নোটস অন নার্সিং ” এর প্রবর্তক ৷ তাঁর হাত ধরে নার্সিং একটি
বিশিষ্ট পেশা হয়ে উঠেছে ৷ যিনি কাজের মধ্যে দেখিয়ে গেছেন নার্সিং শুধু পেশা নয় সেবা ৷


নাইটিঙ্গেল ধনী ব্রিটিশ দম্পতি উইলিয়াম এডওয়াড নাইটিঙ্গেল ও ফ্রান্সিস নাইটিঙ্গেলের সন্তান ৷ ওঁরা ভ্রমণে ইটালি গেলে সেখানকার ফ্লোরেন্স নগরীতে এই “দীপ হাতে রমণী” অর্থাৎ তাঁদের সন্তান ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল জন্মগ্রহন করেন ১৮২০ সালের ১২মে ৷ নাইটিঙ্গেল ছিলেন বহুভাষাবিদ , চিত্রকর ও সঙ্গীত শিল্পী তবু সেসময়ে অবহেলিত নার্সিং পেশায় আসেন ৷ ব্রিটেন , ফ্রান্স , সার্ডিনিয়া ও রাশিয়ার ইউরোপের আধিপত্য নিয়ে ঘটা ১৮৫৩ সালের “ক্রিমিয়ার যুদ্ধে” জাতি , ধর্ম , বর্ণ নির্বিশেষে আহত ,কলেরা , টাইফায়েড সহ নানা রোগে আক্রান্ত অসুস্থ সেনা সহ মানবতার সেবায় তিন বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন ৷ যুদ্ধক্ষেত্রে প্রদীপ হাতে রাতে অসুস্থ মানুষ খুঁজে চিকিৎসা ও শুশ্রূষার ব্যবস্থা করেন ৷ এই সেবার জন্য তাঁকে মানুষ ভাবতে থাকেন “ঈশ্বরের দূত” ৷
একসময় খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনী ( নান) রা শুধু এই কাজ করতেন ৷ আমেরিকায় এঁদের বলা হত “সিস্টার “৷ ধনী পরিবারের দুটি জমিদারীর মালিক শিক্ষিতা সুন্দরী এই রমনী নাইটিংগেল সেবার জন্য মা বা স্ত্রী হতে চাননি ৷ কবি রিচার্ড মঙ্কটন মিলনসের বিবাহ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন ৷ সেসময় হাসপাতাল গুলি ছিল অপরিচ্ছন্ন ৷
নার্সিং পেশার ছিল না সম্মান ৷ পরিবারের আপত্তি
ও বিলাসবহুল জীবনযাত্রা ছেড়ে তিনি মানবতার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেন ৷ ১৮৫৫ সালে আর্তের সেবার জন্য ৩২ লক্ষ টাকা অনুদান সংগ্রহ করেন ৷১৮৬০ সালে ঐ টাকায় চালু করেন লন্ডনে পৃথিবীর
প্রথম বিজ্ঞান ভিত্তিক নার্সিং স্কুল ৷ যার বর্তমানে বিশ্বজোরা খ্যাতি “ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল স্কুল অফ নার্সিং ” নামে ৷
১৮৬৭ সালে নিউইয়র্কে স্থাপন করেন প্রথম “উইমেন্স মেডিক্যাল কলেজ” ৷ তুষারপাত , বৃষ্টি , যুদ্ধ তাঁর কাজে বাধা হতে পারেনি ৷ “লেডি উইথ দি ল্যাম্প ” ১৮৮৩ সালে “রয়ের রেডক্রশ”, ১৯০৭ সালে “অর্ডার অফ মেরিট ” এবং ১৯০৮ সালে “অনারারি ফ্রিডম” খেতাব পান ৷ ১৯১০ সালের ১৩ আগষ্ট ৯০ বছর বয়স বাড়ীতে ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয় ৷
১৯৬৫ সাল থেকে তাঁর জন্মদিন ১২ মে ‘ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে” হিসাবে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে ৷ ভারতে ৬ মে জাতীয় নার্সেস দিবস পালিত হয় ৷ চলে ১২ তারিখ পর্যন্ত ৷ বাংলাদেশে ১৯৭৪ থেকে আর্ন্তজাতিক নার্সেস দিবস পালিত হচ্ছে ৷ প্রতিবছর আর্ন্তজাতিক নার্সেস দিবসে এক একটি বিষয় নির্বাচন করা হয় ৷ এবারের ২০২২ সালের প্রতিপাদ্য বিষয়  “স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় শক্তিশালী নার্স নেতৃত্বের বিকল্প নেই – বিশ্ব স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে নার্সিং খাতে বিনিয়োগ বাড়ান ও নার্সদের অধিকার সংরক্ষণ করুন “( There is no subsititute for strong nurse leadership in health management – increase investment in the nursing sector to ensure global health care and protect the rights of nurses) ৷ ২০২১ সালে ছিল ,” নার্সেরা ভবিষ্যতের স্বাস্থ্যসেবার জন্য একটি লক্ষ্য , এগিয়ে যাওয়ার একটি কন্ঠ “( Nurses a voice to lead a vision for future healthcare). ২০২০র বিষয় ছিল “A voice to lead – Nursing the world health “. নার্সরা চিকিৎসা পরিষেবার মেরুদন্ড ৷ বিপদের মুখোমুখি হয়েও মুমূর্ষর সেবায় অটল থেকে রোগ শয্যা থেকে অপারেশন থিয়েটারে মূল ভরসা ৷ গত ২০১৯ এর প্রতিপাদ্য ছিল ” সবার জন্য স্বাস্থ্য : নার্স , নেতৃত্বে বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর “,
2018 তে ছিল ” A voice to lead health is a human right ” আর ২০১৭ তে ” Nurses a face of change , a vital resources for health”. আসলে বর্তমানে নার্সিং এর ভূমিকা ও সম্মান ক্রমবর্ধমান ৷ লিন্ডা রিচার্ডস বিশ্বের প্রথম প্রশিক্ষিত পেশাদার নার্স ৷ ১৮৭৩ সালে আমেরিকার বোস্টনের নিউ ইংল্যান্ড হসপিটাল ফর উইমেন এন্ড চিলড্রেন থেকে স্নাতক হন ৷
বিশ্বে নিউজিল্যান্ড প্রথম দেশ যেখানে নার্সদের রেজিস্ট্রেশন ১৯০১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছিল৷ এলেন ডাফাটি প্রথম নিবন্ধিত নার্স ৷ একজন চিকিৎসক হয়ে বুঝি নার্স নেতৃত্বের একটি
কন্ঠস্বর ৷ মহিলা ছাড়া পুরুষরাও এখন এই পেশায়
আসছেন ৷

জামাইকান বংশীয় কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা ” মেরী সিয়াকোল” এর ভূমিকাও ক্রিমিয়ার যুদ্ধে কম ছিল না ৷ তাঁর আত্মজীবনী ” ওয়ান্ডারফুল এডভেঞ্চার্স অফ মিসেস সিয়াকোল ইন মেরিল্যান্ডস” -এ তার বিস্তারিত বিবরণ পাই ৷ সালমন রুশদি ” সাট্যানিক ভার্সেস ” বইতে মেরীর কথা উল্লেখ করে বলেছেন হয়তো কৃষ্ণাঙ্গ বলে তিনি সেসময়ের বর্ণবাদী দুনিয়ায় প্রচারের আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ৷ মধ্যযুগের ইসলামেও নার্সদের মহান ভূমিকা ছিল ৷ ইসলামের ইতিহাস পড়তে গিয়ে দেখেছি “রুফাইদা বিন সাদ” এর নার্সের মহান কর্তব্য পালনের কথা ৷ রুফাইদা ছিলেন প্রথম মুসলমান নার্স ৷ যিনি নবী হজরতে মহম্মদের সমসাময়িক ৷ মোহাম্মদের অনুপ্রেরণায় তিনি মদিনা যুদ্ধে ও তারপরে রোগীদের সেবা করেছেন শুধু নয় ৷ বহু মেয়েকে নার্সিং প্রশিক্ষণ দিয়েছেন ৷ তবে, মুসলিমদের মধ্যে মহিলাদের জন্য মেয়ে এবং পুরুষদের জন্য ছেলে নার্সের প্রচলন ছিল ৷ ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে আল মদিনা হাসপাতালে সুদান থেকে প্রশিক্ষিত নার্স আনা হতো ৷ ১৯৯০ সাল থেকে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র নার্সদের ডায়গনোস্টিক , প্যথলজি পরীক্ষা সহ অনেক ওষুধ লেখার অনুমতি দিয়েছে ৷সেদিন আর দূরে নয় যখন নার্সরা তাঁদের আরো মর্যাদা পাবেন ৷ করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সম্মুখ যোদ্ধা হিসাবে সারা পৃথিবীতে এই মুহুর্তে অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মত অসংখ্য নার্স ভয় না পেয়ে মানব সেবায় কাজ করে চলেছেন ৷

কোভিড -১৯ এ আক্রান্ত হয়ে প্রায় সব দেশে অনেক নার্স প্রাণ দিয়েছেন ৷ এইসব অকুতোভয় নার্সদের জন্য আজও এই অণুজীবের বিরুদ্ধে মানুষ লড়াই করে চলেছেন৷ তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের ২০০ তম জন্ম বার্ষিকীতে নার্সদেরই তুলে ধরেছিল ৷ নার্স মানেই সাদা ৷ পোশাকে , কর্মে ও আচরনে ৷ শান্তির প্রতীক এই সাদাকে তাঁরা মনে , মননে ধারন করে জীবন ও যৌবনকে উৎসর্গ করেন ৷ সাদার পৃথিবীতে সেবাই তাঁদের ধর্ম ও ব্রত ৷ নার্সিং পেশায় যুক্ত সবাইক জানাই আমাদের শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন।

More from HealthMore posts in Health »
More from InternationalMore posts in International »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.