#শুধু বিশ্বজুড়ে নয়, শরীর ও মনের সমন্বয়ে সুরের পরশ ই জাদু কাঠি।#
মৃদুলা ঘোষ: কলকাতা, ২১ জুন, ২০২০। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “Music is the highest form of art and those who understand is the highest worship”. এইভাবে ই সঙ্গীতের সাথে মানুষের মনের জীবনের চিরকালের সম্পর্ক বিশ্বজুড়ে। সেই সুরের আগুন কে যদি আমাদের সুস্থতার চাবিকাঠি করে দৈনন্দিন জীবনে ওষুধ খাওয়া কমিয়ে দিতে পারি, তবে সুরের ই জয় হবে। আর সেই পদ্ধতি কে বলে মিউজিক থেরাপি। রাত বাড়ছে কিন্তু ঘুম আসছে না? জগজিৎ সিং অথবা গুলাম আলী র গজল হালকা করে চালিয়ে দেখুন কি হয়! হয়ত, সকাল বেলায় ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই কানে এল অনুপ জলোটার ভজন। মন টা ভালো হবেই। কোনো পার্টি তে কে তুমি নন্দিনী র সাথে ড্যান্স ফ্লোরে নিজেকে আরও তরতাজা লাগছে? গবেষকরা বলছেন এমন ই হয়। তেমন ভাবে শোনাতে পারলে হতাশা গ্রস্ত রোগী ভুলে যেতে পারেন তার কষ্টের কথা। ব্যাথা বেদনায় ভরাক্রান্ত মানুষ সাময়িক ভাবে হলে ও চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারেন। অনিদ্রার রোগীর চোখে নেমে আসতে পারে শান্তি র ঘুম।
স্ট্রেস-টেনশনে জেরবার মানুষ খুঁজে পেতে পারেন তার সমস্যা র সমাধানের পথ। কারন তার পছন্দের গান বা সুর সোজা গিয়ে হানা দেয় মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস এ, যা মানব জীবনের সকল আবেগের কেন্দ্রস্থল। পছন্দের সুরে তারা উদ্দীপিত হয়। সঙ্গীত হবে মুক্ত, সংশয়হীন- এই স্লোগান কে সামনে রেখে ই বিশ্বজুড়ে চলতে থাকা সঙ্গীত আন্দোলন, ১৯৮২সালে আজকের দিনে ওয়ার্ল্ড মিউজিক ডে র রূপ নেয়। ফরাসি ভাষায় ফেট ডে লা মিউজিক, আর বাংলায় বিশ্ব সঙ্গীত দিবস ১৯বছরের পরিক্রমায় আন্তর্জাতিক মাত্রা পায়। যে সঙ্গীত বিশ্বকে এক সূত্রে সমন্বিত করে, সেই সুর যদি মানুষের রোগমুক্তির উপায় হতে পারে তাহলে তা অভূতপূর্ব পন্থা।
তবে, বৈজ্ঞানিক ভিত্তি তে তথ্য প্রমাণ সহ বিশ্বাস যোগ্য বিষয় এখনও পর্যন্ত জোরালো ভাবে উপস্থাপিত হয়নি। যদিও, ১৯৭১সাল থেকে AMRA (American Music Therapy Association) এ বিষয় নিয়ে নিরন্তর গবেষণা করে চলেছে। আমেরিকা ছাড়াও, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা, তানজানিয়া প্রভৃতি দেশে মিউজিক থেরাপি সংক্রান্ত গবেষণা বেশ উল্লেখযোগ্য। একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে সঙ্গীত শ্রবণ কিংবা নিজে ব্যাক্তিগত ভাবে সঙ্গীতে অংশগ্রহণ শরীরে, মনে যে প্রশান্তি নিয়ে আসে তা যে কোনো ব্যক্তি নিজেকে দিয়ে তা উপলব্ধি করতে পারবেন। বেশ কিছু ভারতীয় চিকিৎসক মিউজিক থেরাপি নিয়ে সফলতা র সাথে কাজ করে চলেছেন। মারাত্মক মানসিক চাপ ও টেনশন চলতে থাকলে সুরে ডুবে যাওয়া একটু কঠিন। কিন্তু কোনো মতে একবার ডুবে যেতে পারলে, আঠা র মতো লেগে থাকা স্ট্রেস হরমোন সরিয়ে মন ভালো করা হরমোন ক্ষরিত হয়। তাতে সাময়িক ভালো লাগা যেমন হয়, তেমনি কমে উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রা, দীর্ঘ মেয়াদী অসুখের প্রকোপ। বেশিমাত্রায় অবসাদে আ্যন্টি ডিপ্রেসেন্ট জাতীয় ওষুধ খাওয়ার সঙ্গে মিউজিক থেরাপি করলে আশাতীত ফল পাওয়া যায় বলে বিজ্ঞানী মহল জানিয়েছেন।
কলকাতা র একটি বেসরকারি ক্যান্সার হাসপাতালে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য নিয়মিত ভাবে মিউজিক থেরাপি র সাহায্য নেওয়া হয়। এছাড়াও, কারাগারে বন্দীদের আনন্দ দিতে, মেট্রো রেলে আত্মহত্যা র প্রবনতা কমাতে এখন মিউজিক থেরাপি র সাহায্য নেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় হসপিটাল সিকনেসের প্রকোপ কমাতে, মিউজিক থেরাপি একাই একশো। সেরিব্রাল পালসি, অটিজম, পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষের জন্য ওষুধের সঙ্গে মিউজিক থেরাপি চলতে থাকলে, দ্রুত আরোগ্য আসে। একবিংশ শতাব্দীতে মিউজিক থেরাপি নিয়ে এত চর্চা হচ্ছে ঠিক ই, কিন্তু আমাদের সমাজের সনাতন সংস্কৃতি অনেক আগেই মিউজিক থেরাপি কে আশ্রয় করেছে। প্রাচীন সমাজে যখন ডাক্তারি প্রয়োগের উপায় ছিল না, তখন কলেরা, বসন্ত জাতীয় অসুখের মহামারী লাগলে গ্ৰাম্য লোকেরা রাতভর হরিনাম সংকীর্তন করে পরিবেশ কে সুস্থ রাখতেন। নামগান দ্বারা থেরাপি বা ওষুধ প্রয়োগ গ্ৰাম্য পরিবেশে চালু ছিল।
বিভিন্ন রাগ রাগিনী শ্রবণে রোগ মুক্তি র কথা ও জানা গেছে। যে রাগ গুলি ভৈরবী, রামকেশবের, নাটভারৌ, আশাবরী, আহিরভারৌ, ভীমপালশী, কাফি, পুরিয়া, ইমন, খাম্বাজ, মালকোষ যারা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন অসুখ যেমন, আরথারাইটিস, হাইপার টেনশন, অনিদ্রা, বদহজম, জ্বর, আ্যসমা, মাথা যন্ত্রনা, ইত্যাদি আরও অনেক কিছু নিরাময়ে অনন্য ভূমিকা রাখে এই মিউজিক থেরাপি। মনে রাখতে হবে, এগুলো কোনোটাই প্রথাগত ডাক্তারি প্রেসক্রিপশন নয়, মিউজিক থেরাপি র মেজাজেই গ্রহণ করতে হবে। তবে অসুখের জটিলতা র উপর নির্ভর করে অন্য চিকিৎসার পাশাপাশি এই থেরাপি করা হয়। প্রথমে রোগী র সাথে তার সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক বা মনোবিদ কথা বলে, রোগীর দুঃখ, কষ্ট, সমস্যার কথা জেনে নিয়ে মিউজিক থেরাপি র ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়। তার পছন্দের গান, সুরের তালিকা বানানো হয়। একজন মিউজিক থেরাপিস্ট নিয়মিত নির্দিষ্ট মাত্রায় তা শোনাতে থাকেন। তাতে তার কষ্ট কতটা কমছে তা বিভিন্ন পদ্ধতিতে মেপে দেখেন। কিছু দিন থেরাপি নেওয়ার পর অনেক সময়ই ওষুধের মাত্রা কমে যায়। কারন, টেনশন, কমে গেলে ব্যক্তি সঠিক জীবনযাপন এ উদ্যোগী হন। তার হাত ধরে রোগের প্রকোপ ও কমে যায়। এমন টা কিন্তু নিজে নিজেই সম্ভব। সারাদিনে যদি পনেরো মিনিট করে কয়েকবার নিজের পছন্দের গান বা যন্ত্রের সুর শোনা র অভ্যেস করেন, বা ভালোবেসে শুনতে পারেন, কর্মব্যস্ততার ক্লান্তি, বিরক্তি, অস্বস্তি সব দূর হয়ে যাবে। এমনিতে গান বাজনার চর্চা আমাদের প্রশান্তি এনে দেয়। The Marchant of Venice থেকে শেক্সপিয়ার কে উদ্ধৃত করে বলতে হয়, অন্তরে যার সঙ্গীত নেই সেরকম মানুষ কে বিশ্বাস করা অনুচিত।
বিশ্ব সঙ্গীত দিবসের দীপ্তি যেন সবার মনে প্রানে প্রসারতা আনে।যেখানে রাতের নীরবতা,স্নিগ্ধতা স্বপ্নের মায়াজালে আবদ্ধ করে , সেখানে সুর, সঙ্গীত, সাধনা মিলেমিশে একাকার। এমন ভাবে ই বিশ্বজুড়ে চলবে সুরের খেলা।
Be First to Comment