জন্মদিনে স্মরণঃ অ জি তে শ ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
বাবলু ভট্টাচার্য : বিশ্বের খ্যাতনামা নাট্যকারদের নাটক এই বঙ্গে বসে দেখছেন বাঙালি দর্শক। তারা নাটক দেখে হাসছেন, কাঁদছেন, রেগে যাচ্ছেন, কখনও বা ভয়ে শিউরে উঠছেন। অর্ধশতাব্দীরও আগে বঙ্গ থিয়েটারকে বিশ্ব থিয়েটারের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন যিনি তাঁর নাম অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
ছ’ফুটের উপর লম্বা। বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। আশ্চর্য চাহনি। প্রাণখোলা হাসি। দাপিয়ে অভিনয় করছেন মঞ্চে। গান গাইছেন। নাচছেন। প্রযোজনা নিয়ে দৌঁড়ে বেড়াচ্ছেন কলকাতা থেকে সারা বাংলা। বাংলার বাইরে। নেপথ্যে চলছে নাটক লেখা। নাটক নির্মাণ। নির্দেশনা। সংগঠন সামলানো। স্কুলে পড়ানো।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে এমন শিল্পমুখী প্রতিভা বাঙালি দেখেছে কি না সন্দেহ। শুধু কি বাংলা থিয়েটার! রেডিও নাটক, সিনেমা, যাত্রা, কবিতা লেখা, সবেতেই নিমজ্জিত ছিলেন বাংলা মঞ্চের এই ‘শের আফগান’।
ভুবনমোহন ও লক্ষ্মীরানির বড় ছেলে অজিত। বাবা কোলিয়ারিতে কাজ করেন। আসানসোল শিল্পাঞ্চলের রামনগরে। একটু বড় হতেই অজিত দেখলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। সেটা ১৯৪২, তখন তার বয়স বছর নয়েক। জাপানি বোমার ভয়ে ভুবনমোহন তাঁকে পুরুলিয়ার ঝালদায় এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।
অষ্টম শ্রেণিতে ওঠার পর ভুবনমোহন বদলি হয়ে গেলেন ঝরিয়ার কাছে চাসনালায়। সেখানেই নাট্যগুরুর দেখা পেলেন অজিত। নাম প্রবোধবিকাশ চৌধুরী। তাঁর সঙ্গেই পাথরডি রেলওয়ে ইনস্টিটিউটে ‘টিপু সুলতান’-এ জীবনের প্রথম অভিনয় করেন অজিত। আসানসোলের বিবি কলেজে থেকে আইএ পাশ করে সোজা কলকাতা। ভর্তি হন মণীন্দ্র কলেজে।
ইংরেজির স্নাতক অজিত শিক্ষক হিসেবে কাজে যোগ দিলেন বাগুইআটির হিন্দু বিদ্যাপীঠের ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে। পার্টি কর্মী, তথা গণনাট্য সঙ্ঘ পাতিপুকুর শাখার শিল্পী অজিতকে তখন সবাই এক ডাকে চেনে।
দমদম আঞ্চলিক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর দায়িত্ব পড়ে গণনাট্য সঙ্ঘের চারটি শাখাকে মিলিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনা তৈরি করার। মঞ্চস্থ হয় ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’। তার পর ধারাবাহিক ভাবে সঙ্ঘের কাজ করেছেন তিনি, মূলত থিয়েটারকে আঁকড়ে।
তাই গণনাট্য সঙ্ঘ থেকে সরে এসে ১৯৬০-এর ২৯ জুন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে, দীপেন্দ্র সেনগুপ্ত এবং অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহায়তায় স্বতন্ত্র সত্তায় আত্মপ্রকাশ করল ‘নান্দীকার’।
এই দলের প্রথম নাটক ইবসেনের ‘ঘোস্টস’। বাংলায় ‘বিদেহী’। ’৬০-’৬১-তে পর পর কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ করে নান্দীকার। মৌলিক এবং বিদেশি নাটক নির্ভর ‘দাও ফিরে সে অরণ্য’, ‘সেতুবন্ধন’, ‘চার অধ্যায়’, ‘প্রস্তাব’ করার পর ১৯৬১ সালের ১২ নভেম্বর অভিনীত হল ‘নাট্যকারের সন্ধানে ছ’টি চরিত্র’। এই নাটক বাংলা থিয়েটারে নান্দীকার-এর নাম দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।
অজিতেশের নির্দেশনায় একের পর এক মঞ্চসফল প্রযোজনা করেছে নান্দীকার। ‘মঞ্জরী আমের মঞ্জরী’, ‘যখন একা’, ‘নানা রঙের দিন’, ‘তিন পয়সার পালা’, ‘শের আফগান’, ‘ভাল মানুষ’— তালিকায় নাম বাড়তেই থাকে। নির্দেশনার পাশাপাশি নাটকের গান তৈরি ও সুর দেয়া, বিদেশি নাটকের আত্তীকরণ, মৌলিক নাটক লেখা— সবই চলতে থাকে অজিতেশের।
১৯৭৭-এ ‘সাংগঠনিক কারণ’-এ নিজেরই তৈরি করা দল নান্দীকার ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন অজিতেশ। ওই বছরের ৯ সেপ্টেম্বর তিনি গঠন করলেন নতুন সংস্থা, ‘নান্দীমুখ’।
ষাটের দশক থেকে তিনি সিনেমাতেও অভিনয় করা শুরু করেন। সব মিলিয়ে তাঁর অভিনীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা পঞ্চাশের কাছাকাছি। এর মধ্যে কয়েকটি হিন্দি ছবিও আছে। তপন সিংহ, নবেন্দু চট্টোপাধ্যায়, দীনেন গুপ্ত, অরুন্ধতী দেবী, মৃণাল সেন, জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, তরুণ মজুমদার ছাড়াও আরও অনেক পরিচালকের নির্দেশনায় তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
যাত্রার ক্ষেত্রেও একই রকম সফল অজিতেশ। এবং জনপ্রিয়। গ্রামবাংলার মানুষ যাত্রাশিল্পী অজিতেশের অভিনয়ে বুঁদ হয়ে থেকেছেন। থিয়েটারের বৃত্তের বাইরে একটা বড় সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছতেই অজিতেশের যাত্রায় যোগ দেয়া।
১৯৮৩ সালের ১৩ অক্টোবর মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান প্রবাদপ্রতিম এই অভিনেতা।
অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৩৩ সালের আজকের দিনে (৩০ সেপ্টেম্বর) পুরুলিয়ার রোপো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment