সঙ্গীতা চৌধুরী : কলকাতা, ২৪, ফেব্রুয়ারি, ২০২১। মডেলিং এখন বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে উঠেছে। ফ্যাশন ফটোগ্রাফির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে মডেলিং-এর সুযোগ আরও বেড়ে গেছে। বিভিন্ন ধরনের মডেলিং রয়েছে। মডেলিং হল সেই অনন্য পেশাগুলির মধ্যে একটি যা কারো নির্দিষ্ট প্রতিভা প্রয়োগ করতে অনেক আকর্ষণীয় উপায়ে তাকে সাহায্য করে। ১০টি মূল ধরনের মডেলিং রয়েছে। যেমন- (১) ফ্যাশন মডেল (২) রানওয়ে মডেল (৩) সুইমসুট এবং অন্তর্বাসের মডেল (৪) বাণিজ্যিক মডেল (৫) ফিটনেস মডেল (৬) অংশ মডেল (৭) ফিট মডেল, (৮) প্রচারমূলক মডেল (৯) গ্ল্যামার মডেল (১০) প্রিন্ট মডেল। মডেলিং- এই বিভিন্ন দিকগুলোর মধ্যে ফ্যাশন মডেল এবং রানওয়েতে হাঁটা মডেলরাই সর্বাধিক পরিচিতি অর্জন করেছেন। তবে কিছু মডেল একটি বিশেষায়িত বিভাগ নিয়ে পরীক্ষা করেন। আবার কেউ কেউ একাধিক ধরনের মডেলিং চেষ্টা করেন এমন ঘরানার সন্ধানের জন্য যা তাদের পক্ষে সবচেয়ে উপযুক্ত।
একটা সময় ছিল যখন এই পেশাকে সুনজরে দেখা হতো না কিন্তু বর্তমানে অবিবাহিত থেকে বিবাহিত নারী সকলেই এই মডেলিং – প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছেন। মডেলিং-এর এই ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারন অনুসন্ধানে বেশ কিছু মডেলের মনের অন্দরে উঁকি মারা গেল –

মিসেস ইন্ডিয়া ইউনিভার্স আর্থ ২০১৮ অপ্সরা গুহঠাকুরতার সঙ্গে আলাপচারিতায় অনেক কিছুই জানা গেল, অপ্সরার কথায় , ” আমি ছোটবেলা থেকেই এই গ্ল্যামার জগতের প্রতি আকৃষ্ট ছিলাম। তবে আমার বাড়ির অনুমতি না থাকায় সে সময় আমি এই শিল্পে আসার সুযোগ পাই নি। আসলে আমার বাবা ঠিক কনজারভেটিভ নয়, তবে পড়াশোনার ব্যাপারে খুব কঠোর ছিলেন। কারণ আমাদের বাড়িতে পড়াশোনাকে খুব প্রাধান্য দেওয়া হতো। আমার মা একজন শিক্ষিকা ছিলেন , ওনার একটি স্কুল ছিল যেখানে মা প্রিন্সিপাল ছিলেন , তাছাড়া আমার পিসিরাও শিক্ষিকা ছিলেন। আমার বাবা ছিলেন ইন্জিনিয়ার। আমি এরকম একটা শিক্ষার পরিমন্ডলে বড় হয়ে উঠেছি। তাই আমার বাবার বক্তব্যই ছিল আগে পড়াশোনাটা সঠিকভাবে করে নিজের ভালো কেরিয়ার তৈরি করো, তারপর অন্যকিছু করার কথা ভাববে। বাবার কথা অমান্য করিনি। আমি ওড়িশি ডান্স নিয়ে মাস্টার্স কমপ্লিট করি , গার্ডেন হাইস্কুলে দশ বছর শিক্ষকতাও করেছি। আমার নিজস্ব ডান্স অ্যাকাডেমি আছে। স্কুল ও কলেজে থাকাকালীন আমি বহু বার মডেলিং করেছি , অনেক প্রাইজও পেয়েছি। তবে একটা বিশেষ সময়ের পর আমার সেই পুরনো স্বপ্ন আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। তখন খোঁজ শুরু করি এবং সুযোগ ও এসে যায়। মিসেস ইন্ডিয়া ইউনিভার্স হবার পর ২০১৯ -এ ডমিনিকান রিপাবলিকে ৪০ টি দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতায় আমি ইন্ডিয়াকে রিপ্রেজেন্ট করি। তাতে সেকেন্ড রানার আপ হয়েছি। এইভাবে মডেলিং -এর মাধ্যমেই দেশে- বিদেশে আমার পরিচিতি তৈরি হয়েছে।

মডেলিং -এর ক্ষেত্রে আমি র্যাম্পে প্রচুর হেঁটেছি , শো স্টপার হয়েছি । তাছাড়া মডেলদের গ্রুমিং করাই ,আমার একটা নিজস্ব গ্রুম অ্যাকাডেমিও রয়েছে। তবে খুব সম্প্রতি আমি একটা ব্র্যান্ড লঞ্চ করেছি ,যেটার নাম ‘ অপ্সরা – দা ডিজাইনার স্টুডিও’। এই সব নিয়ে আমি এখন খুবই ব্যস্ত। তবে এখন এই কাজের পেছনে আমার বাবার বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ির পূর্ণ সমর্থন আছে। বলা যায় শ্বশুর বাড়ি আমার টেলেন্টকে নষ্ট হতে না দিয়ে এক সন্তানের জননী হওয়ার পরও স্বপ্ন পূরণের দিকে আমাকে এগিয়ে দিয়েছে। এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে মডেলিং-এর দারুণ জনপ্রিয়তার পেছনে কারন হিসেবে আমার মনে হয়, আগেকার দিনে যখন আমি মডেলিং করতে চেয়েছিলাম তখন ডিজিটাল মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব কিন্তু একদমই ছিল না। তাই তখনকার মানুষের মডেলিং সম্পর্কে সঠিক কোন ধারণা তৈরি হয় নি। মানুষ মডেলিং মানেই জানতো স্বল্প পোশাকে র্যাম্পে হাঁটা এবং শরীর প্রদর্শন।

এই ধারণা যে একেবারেই ভ্রান্ত তা ভেঙে দিয়েছে নানা ধরনের মডেল, যেমন- এখন প্লাস সাইজ মডেল হয়, স্পেশাল এবিলিটি দিয়ে মডেল, ট্রান্স জেন্ডার মডেল, আবার মিস্টার – মিসেস এন্ড ট্রান্স জেন্ডার নিয়ে মডেল হচ্ছে। এই ভাবে আমাদের মানসিকতা কিছুটা ডেভেলপ করছে । তাছাড়া তখন টেলিভিশন ও নিউজপেপার ছাড়া সোশ্যাল ডিজিটাল মিডিয়ার প্রভাব একেবারেই ছিল না, কিন্তু এখন সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে মানুষের সবকিছুই হাতের মুঠোয়।

মডেলিং -এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও অনেকটাই স্পষ্ট হয়েছে। তাই মডেলিং-এর ক্ষেত্রে আজকাল পারিবারিক অন্তরায় দূরীভূত হয়েছে বলে অনেকেই এখন মডেলিং -এর মাধ্যমে নিজেদের কেরিয়ার তৈরি করতে চাইছে। “

তেরো বছর কেবিন ক্রু থাকার পর দুবছর ধরে মডেলিং শুরু করেছেন টিনা গৌর, ইতিমধ্যে বহু শিরোপা জুটেছে, টিনা জানালেন , ” ২০১৮ -তে ফাস্ট রানার আপ ছিলাম মিসেস বেঙ্গলে এবং একই বছরে মিসেস ইন্ডিয়া হয়েছি। আমার কাজের জন্য বেশ কিছু অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছি।আমি ইউটিউবে একটা ওয়েব সিরিজে কাজ করেছি। তাতে লিড চরিত্র ছিল। ভবিষ্যতে ভালো চরিত্র পেলে আরও অভিনয়ের ইচ্ছে আছে। আবার মডেলিং-এর পাশাপাশি আমি গ্রুমিং করাই। ব্যক্তিত্বের ডেভেলপমেন্টেরও ট্রেনার।

যারা এই প্রফেশনে আসতে চায় আমি তাদের সবদিক দিয়ে গাইড করবো। কারন অনেকে ইচ্ছে থাকলেও সঠিক পথনির্দেশ পায় না। ক্ষেত্র বিশেষে বিনা পারিশ্রমিকেও আমি সবার পাশে থাকতে চাই। মডেলিং- এর ক্ষেত্রে আমার বাবার বাড়ি ও শ্বশুর বাড়ির দুই পরিবারই আমাকে খুব সমর্থন করে। তারা চায় আমি যেন আরও অনেক দূর এগোতে পারি। মেয়েদের মধ্যে এই মডেলিং-এর স্বপ্নের বীজ বপন করেছেন সুস্মিতা সেন, ঐশ্বর্য রাই , প্রিয়াঙ্কা চোপড়ারা। তাদের এগিয়ে যাওয়া দেখে অন্য মেয়েরাও সাহস করে মডেলিং করার দিকে এগিয়েছে।

আগে শুধু মিস ক্যাটাগরি ছিল, কিন্তু এখন মিসেস থেকে শুরু করে অনেক ক্যাটাগরি আছে। এতে অনেক ট্যালেন্টেড মহিলারা যারা আগে কাজের সুযোগ পায়নি তারা বিয়ের পরও মডেলিং-এর মাধ্যমে নতুন করে নিজের পরিচয় তৈরি করতে পারছে। এইভাবেই মডেলিং এত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।”

টালিগঞ্জের নতুন মুখ পুস্পিতা লোধ একজন নৃত্যশিল্পী। নাচের শো করতে গিয়েই অভিনয়ের সুযোগ আসে এবং বহু সিরিয়ালে ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেন। আর এই অভিনয় করতে করতেই এক সময় মডেলিং -এর দিকে চলে যায়, এখন অভিনয় থেকে সরে গিয়ে নিজেকে একজন প্রতিষ্ঠিত মডেল হিসেবেই দেখতে চায়। মডেলিং সম্পর্কে পুস্পিতার বক্তব্য, “আমার মতে কোন প্রফেশনই ছোট নয় ,

সব প্রফেশনেরই আলাদা গুরুত্ব আছে। তবে কেউ যদি খারাপ- ভালোর প্রশ্ন তোলে, তাহলে বলবো সব প্রফেশনেই ভালো ও খারাপ দুইই আছে। তাই কোন প্রফেশনকেই আলাদা করে বলা যায় না যে এটা ভালো, আর এটা খারাপ।তাই তুমি কোনটা গ্রহণ করবে সেটা তোমার চয়েস।

বর্তমানে মডেলিং -এর এই জনপ্রিয়তার পেছনে অবশ্যই আমাদের পূর্বসুরী সুস্মিতা সেন, বিপাশা বসুর অনেকটাই ভূমিকা রয়েছে। ওদের সাফল্য দেখেই আমাদের মতো নতুনরা এই প্রফেশনে আসার সাহস পেয়েছে। “

মডেলিং করতে গিয়ে মস্তক মুন্ডন করার সাহস দেখিয়েছেন প্রথম ফটো শ্যুটে মডেল ঈশানী। ঝাড়খণ্ডের মেয়ে ঈশানী উচ্চ মাধ্যমিকের পর ফটোগ্রাফির ওপর ডিপ্লোমা করেন, ফটোগ্রাফি নিয়ে কেরিয়ার তৈরির ইচ্ছে থাকলেও হঠাৎ করেই মডেলিং -এ চলে আসেন। তবে ঈশানী জানিয়েছেন , ” আমার কাছে ফাস্ট প্রায়োরিটি ফটোগ্রাফি ,আর মডেলিং – এর জায়গা তার পরে। আমার কোনদিন মাথাতেও আসে নি যে আমি মডেলিং করবো, কিন্তু ফটোগ্রাফির ওয়ার্কশপ করার সময় মডেলিং -এর প্রস্তাব পাই । তবে সেক্ষেত্রে সত্ত্ব ছিল যে মাথা ন্যাড়া করতে হবে, বাড়ির অনুমতি নিয়ে আমি এককথায় রাজি হয়ে যাই।

২০১৯ -এর ডিসেম্বরে আমার প্রথম ফটোশ্যুট ছিল। এরপর চুল নিয়ে নানা এক্সপেরিমেন্ট করেছি। আসলে ছোটবেলা থেকেই আমার ক্যামেরার সামনে কাজের ব্যাপারে একটা কৌতূহল ছিল ,আমার মা এক সময় অভিনয় জগতের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তাই মায়ের কাছ থেকে অনস্ক্রিন কি রকম কাজ হয় সেটা জেনেছি। তাও কখনো ভাবিনি যে আমি মডেলিং করবো। বড় হয়ে সুস্মিতা সেনের কাজ দেখেছি , হলিউডের বিখ্যাত বিখ্যাত মডেলদের
কাজও খুব ভালো করে দেখেছি ফটোগ্রাফির জন্য।

আমার ফ্যাশন ফটোগ্রাফি করারই বরাবর ইচ্ছে, আবার মডেলিং করলে ফ্যাশন মডেলিং- ই করবো। এখন দেখা যাক মডেলিং -এর এই দারুন জনপ্রিয়তার সময়ে ডেসটিনি আমায় কোন দিকে ঠেলে দেয় !


Be First to Comment