মধুমিতা শাস্ত্রী : ২ আগস্ট, ২০২০। করোনা অতিমারীতে জীবনের ছন্দ কেমন যেন গুলিয়ে গিয়েছে। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ঘুণাক্ষরে কেউ টেরই পাইনি, এরকম দীর্ঘ গৃহবন্দী জীবন আসতে চলছে আমাদের। কোনও সামাজিক ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে আমরা একত্রিত হতে পারব না। কোনও মিলন উৎসবে ভিড় থাকবে না। আর লকডাউন যত দীর্ঘ হচ্ছে ততই আমাদের আনন্দ উৎসবগুলিকে ভুলতে বসেছি। আগে বাজারে গেলে দোকানদারদের পসরা দেখে ঠিক বোঝা যেতো আগামী দিন কী উৎসব আসছে। যেমন ঈদের দু’সপ্তাহ আগে থেকে রাস্তার ধারে লাচ্চা, সিমাই, কাজু, কিসমিসের সারি সারি দোকান বসত। আবার ধরুন শনি দেবতার পূজা, পুরো শ্রাবণ মাস জুড়ে সমস্ত ফুলের দোকানে যেমন নীলকণ্ঠ ফুল পাবেন। তেমনি দশকর্মার দোকানে আপনাকে বলে দিতে হবে না, কী কী উপকরণ লাগবে। শুধু শনি দেবতার পূজা দেব বল্লেই হল। আসলে যখন যে পূজা হয় সেই অনুযায়ী পসরা তৈরি করে বসে। কিন্তু এখন বাজারের পরিস্থিতি দেখে বোঝার উপায় নেই। এই যেমন কাল রাখী পূর্ণিমা কিন্তু বাজার দেখে বোঝার উপায় নেই। আগে হলে পাড়ার দোকানে পর্যন্ত রাখী ঝুলতো এক সপ্তাহ আগে থেকে।
বর্তমানে উৎসবের মানসিকতা না থাকলেও সময় তো থেমে থাকবে না। সময় তার নিয়মে বহমান। আর সেই সঙ্গেই পরস্পর উৎসবগুলি নীরবে এসে চলে যাচ্ছে। তেমনিভাবেই এবছরেও রাখীবন্ধন উৎসব এসেছে। অনেকেই এই দিনটিতে দিদি বা বোনরা দাদা বা ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় রাখী পরায়। এই রাখীবন্ধনের অনেক ইতিহাস আছে। একটি কিংবদন্তি অনুযায়ী ৩২৬ খ্রীস্টপূর্বাব্দে মহামতি আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করলে আলেকজান্ডারের স্ত্রী রেজানা রাজা পুরুকে একটি পবিত্র সুতা পাঠিয়ে তাঁকে অনুরোধ করেন, তিনি যেন আলেকজান্ডারের ক্ষতি না করেন। পুরু ছিলেন কাটোচ রাজা। তিনি রাখীর সন্মান রেখে যুদ্ধ ক্ষেত্রে নিজে আলেকজান্ডারকে আঘাত করেননি। ধারণা এরপর থেকেই রাখীবন্ধন উৎসব পালিত হয়ে আসছে। একটি গল্প অনুযায়ী গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করলে চিতোরের বিধবা রানি কর্ণবতী ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে একটি রাখী পাঠিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করেন। কর্ণবতীর রাখী প্রেরণে অভিভূত হয়ে হুমায়ুন চিতোর রক্ষা করার জন্য সৈন্য প্রেরণ করেন। যদিও সমসাময়িক ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে রাখী প্রেরণের কথা অবশ্য জানা যায় না। কোন কোন ঐতিহাসিক এর সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে মধ্য-সপ্তদশ শতকের রাজস্থানী লোকগাথায় এর উল্লেখ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রাখীবন্ধন উৎসব। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ প্রতিরোধ করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাখীবন্ধন উৎসব পালন করেছিলেন। সেই সময় ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা চরম পর্যায়ে ছিল। হিন্দু ও মুসলিম এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে একতা আনার জন্য রাখীবন্ধন উৎসব পালন করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যে ভাতৃত্ববোধ জাগিয়ে তোলা এবং ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সবাইকে রাখীবন্ধন উৎসব পালন করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিলেন।
প্রতিবছর শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে রাখীবন্ধন উৎসব পালিত হয়। ভাই-বোনের মধুর স্মৃতি এই উৎসব। ভাই বা দাদার মঙ্গল কামনায় দিদি বা বোন রাখী পরায়। ভাই বোন দূরে থাকলে আসতে না পারলে পোস্টের মাধ্যমেও রাখী পাঠাতে দেখা গিয়েছে।
Be First to Comment